আইন নিজ হাতে না নিতে বঙ্গবন্ধুর কঠোর হুঁশিয়ারি

আইন নিজ হাতে না নিতে বঙ্গবন্ধুর কঠোর হুঁশিয়ারি

নিউজ ডেস্ক:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, প্রয়োজনে যেকোনও মুহূর্তে সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পাশে দাঁড়াবে। কাজেই নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া উচিত হবে না। তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, ‘যদি কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নেয়, তাহলে দেশের আইন সেই দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হবে। সেই ব্যক্তি যে-ই হোক, তাকে রেহাই দেওয়া হবে ন।’

অপর এক খবরে প্রকাশ, বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার সম্ভাব্য সবকিছুই করছে।’

সেক্রেটারিয়েটে সালিশ

বিপিআই জানায়, ২৪ ফেব্রুয়ারি সেক্রেটারিয়েট ভবন প্রাঙ্গণে দুই বিবদমান দলের বিরোধ মেটাতে হয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঘটনার বিবরণীতে জানা যায়, সমবায় ক্যান্টিনে সেক্রেটারিয়েটের একজন কর্মচারীর সঙ্গে এক ক্যান্টিন বেয়ারার বিরোধ বাধে। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে এবং দুই পক্ষকে শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তখন ছিল মধ্যাহ্নভোজের সময়। বঙ্গবন্ধু বাড়ি যাচ্ছিলেন তাঁর সেক্রেটারিয়েটের অফিস থেকে। তার সঙ্গে ছিলেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুকে দেখে বিবদমান দুই পক্ষ তার কাছে ছুটে যায় এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনেন এবং নিজের হাতে আইন না তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘নিজের হাতে যদি কেউ আইন তুলে নেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সে ব্যক্তি যে-ই হোক না কেন, এ ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার জন্য তিনি পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে নির্দেশ দেন, তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপের ফলে দীর্ঘস্থায়ী বিরোধের সন্তোষজনক সমাধান ঘটে। সেখানে সমবেত জনতা গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে এবং জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানায়।

‘পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের ফেরানোর চেষ্টা চলছে’

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার সম্ভাব্য সবকিছুই করছে।’ পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের প্রায় একশ’ আত্মীয়-স্বজন ১৯৭২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে বঙ্গবন্ধু তাদের বলেন, ‘পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালিদের অবস্থা সম্পর্কে তার সরকার সম্পূর্ণ অবহিত রয়েছে। এই বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে।’

গণহত্যার বিচারে ট্রাইব্যুনাল

গণহত্যার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানান ড. কামাল হোসেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা বাংলাদেশে পাইকারি গণহত্যা এবং অন্যান্য অপরাধে লিপ্ত ছিল, সেইসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর্যায় রয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালেই দায়ী পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে।’

মন্ত্রীদের বেতন এক হাজার টাকা

বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা মাসে মাত্র এক হাজার টাকা করে বেতন নেবেন। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে অবশ্য মন্ত্রীদের বেতন হবে দেড় হাজার টাকা। স্বাধীনতার প্রারম্ভিককালে দেশ যে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কৃচ্ছ্রতা সাধনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ও অর্থনীতিকে জোরদার করার অভিযানে শরিক হওয়া থেকে মন্ত্রীরা মাসে মাত্র এক হাজার টাকা করে নিতে সম্মত হন। সরকারের অবস্থার উন্নতি না ঘটা অবধি তারা বাকি টাকাটাও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চান বলেও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর রাশিয়া সফর নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি

২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাঁচ দিনের সফরে রাশিয়া যান। বঙ্গবন্ধুর সেসময়ে প্রথমবারের মতো রাশিয়া সফর নিয়ে বেশ পরিকল্পনা চলছিল। সফরকালে রুশ নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে সোভিয়েত সাহায্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছিল। বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে কিছু যাত্রীবাহী বিমান চাইবে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশ করা হয়। অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় কোন কোন ক্ষেত্রে কী পরিমাণ সাহায্য রাশিয়া দিতে পারে, সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনারও কথা ছিল।

রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু ছিল। এদিকে বাংলাদেশ সরকার যে চারটি মূলনীতি ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে সমাজতন্ত্র। সেটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে, তা বাস্তবায়নে রাশিয়া বাংলাদেশকে সাহায্য দিতে এগিয়ে আসবে সেটাই স্বাভাবিক।

সেই সময়কার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে রাশিয়া দরাজ হাতে সাহায্য দিতে পারে বলেও ধরে নেওয়া হয়েছিল। এর মাত্র কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছেন যে. শর্তযুক্ত কোনও সাহায্য বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না। পশ্চিমা দেশের তুলনায় রাশিয়া অনেক সহজ কিস্তিতে অল্প সুদে ঋণ দিতো।

শিশুদের আঁকা ছবি

মুক্তি সংগ্রাম তথা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্যাতনের কাহিনি অবলম্বনে বাংলাদেশের শিশুদের আঁকা ৭৫টি চিত্রশিল্পের একটা পোর্টফোলিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে দেওয়া হয়। শিশুরা মুক্তিযুদ্ধকে তাদের চোখে যেভাবে ধারণ করেছে, সেটাই তুলে ধরেছে। সোভিয়েত সফরে যাওয়ার সময় এই ছবি সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকেই আঁকানো হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অতিথি ইন্দিরা গান্ধী

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বাংলাদেশ সফরে আসেন। আগমনের পর ওইদিন বিকালে রমনা ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দেন তিনি। ২৪ ফেব্রুয়ারি তার ঢাকা সফর কর্মসূচি মোটামুটি চূড়ান্তভাবে জানা যায়। ১৭ মার্চ দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাঁর জন্য শ্রীমতি গান্ধী কিছু উপহার নিয়ে আসবেন। এটা জানা গেলেও উপহার সামগ্রীতে কী কী আনবেন তা প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি। বঙ্গভবনে ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে এক রাষ্ট্রীয় ভোজের আয়োজন করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী খান সেনাদের হামলায় বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করবেন বলেও জানানো হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *